দ্যা বাংলা এক্সপ্রেস ডটকম: ব্যাংক থেকে উত্তোলনকৃত টাকা আত্মসাত করার জন্য ভাড়াটে খুনী ব্যবহার করে বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে খুনের তথ্য জানিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিমের মৃত্যুর ঘটনার তদন্তে এমন তথ্য পেয়েছে পিবিআই৷
রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে পিবিআই’র নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, মৃত্যু দুই মাস আগে আব্দুল হালিমের ব্যাংক থেকে তোলা ৩০ লাখ টাকা আত্মসাতের লোভে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে লোক ভাড়া করে বাবাকে খুন করান ছেলে এইচএম মাসুদ৷
ঘটনার সাথে জড়িত আলামত ও বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরার হার্ডড্রাইভ (ডিভিআর) উদ্ধারের পর বিষয়টি নিশ্চিত হয় তদন্তকারী সংস্থা৷
এ ঘটনায় ‘ভাড়াটে খুনি’ মো. রুবেল হত্যার বিষয়টি স্বীকার করে গত শনিবার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন বলেও জানায় পিবিআই৷
গত ১ ফেব্রুয়ারি সকালে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার এনায়েতনগর ইউনিয়নের মাওলাবাজার এলাকায় নিজ বাসা থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিমের (৭২) মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ৷ ওই সময় তার একমাত্র ছেলে মাসুদ (৪২) দাবি করেন, ৩১ জানুয়ারি দিবাগত রাতে তাদের বাসায় ঢুকে তার হাত, পা ও মুখ বেঁধে, বৃদ্ধ বাবাকে খুন করে নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার লুটে নিয়ে গেছে ডাকাত দল৷
তবে ঘটনাস্থলের আলামত ও নিহতের ছেলের বক্তব্য নিয়ে ‘সন্দিহান’ পুলিশ৷ ওই সময় ফতুল্লা মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ রিজাউল হক বলেন, ডাকাতরা কীভাবে ওই বাসায় ঢুকল তা স্পষ্ট নয় পুলিশের কাছে। বাড়িতে চারটি সিসি ক্যামেরা থাকলেও মেশিন থেকে হার্ডড্রাইভ খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ সে কারণে এ ঘটনাকে রহস্যজনক বলে জানিয়েছিলেন ওসি৷
এ ঘটনায় ১ ফেব্রুয়ারি ফতুল্লা মডেল থানায় অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেন নিহতের জামাতা৷ মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ্য করেন, নিহত আব্দুল হালিমের এক ছেলে ও দুই মেয়ে৷ মেয়েরা তার শ্বশুরবাড়িতে থাকে৷ বাদীর শাশুড়ি মারা যাবার পর শ্বশুর ও তার একমাত্র ছেলে মাসুদ ও তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে মাওলাবাজারের নিজ বাড়িতে দ্বিতীয়তলার একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন৷
৩১ জানুয়ারি রাত আড়াইটার দিকে লোক মারফত জানতে পারেন, বাদীর শ্বশুরবাড়িতে বড় ধরনের ডাকাতি হয়েছে৷ তৎক্ষনাৎ বাড়ি ফিরে দেখেন তাক শ্বশুর খাটের উপর মৃত পড়ে আছেন৷ তার শ্যালক জানান, দু’দিন আগে তার স্ত্রী-সন্তান শ্বশুরবাড়ি গেছেন৷ রাত দশটার দিকে খাওয়া-দাওয়া শেষে শ্বশুড় ও শ্যালক নিজ কক্ষে শুয়ে পড়েন৷
‘রাত দশটা থেকে সোয়া দুইটা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তিন অজ্ঞাত ব্যক্তি শ্যালকের কক্ষে ঢুকে তাকে পাটের রশি দিয়ে হাত-পা ও মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে শ্বশুরের কক্ষে গিয়ে তাকে ভয় দেখিয়ে আলমারিতে থাকা শ্বশুরের ৩০ লাখ ও তার শ্যালকের ২ লাখ টাকা লুটে নেয়৷ শ্বশুরের টাকা দুই মাস আগে আইএফআইসি ইসলামী ব্যাংক থেকে তোলা হয়৷ টাকা লিটের পর আসামিরা সিসিক্যামেরার হার্ডড্রাইভ নিয়ে যায়৷ বাধা দিলে শ্বশুরকে শ্বাসরোধ করে খুন করে পালিয়ে যায়৷
আসামিরা চলে যাবার পর শ্যালক হাত, মুখ বাঁধা অবস্থায় দরজা ধাক্কালে শব্দ পেয়ে ভাড়াটিয়া মাহিনুর (৪০) ও তার স্বামী দেলোয়ার (৪৫) ফ্ল্যাটের দরজা খুেিল ঘরের ভেতর প্রবেশ করে তার শ্যালোকের হাত ও মুখের বাঁধন খুলে দেয়৷’
চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি থানা পুলিশের পাশাপাশি তারাও ছায়াতদন্ত করেন বলে জানান পিবিআই পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম৷ তিনি বলেন, গত ১০ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্তের দায়িত্ব নেয় পিবিআই৷ দায়িত্ব পাবার ২৪ ঘন্টার মধ্যে এসআই শাকিল হোসেন ও এসআই কামরুল হাসানকে নিয়ে ঘটনার রহস্য উদঘাটন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মাজহারুল ইসলাম৷
পিবিআই বলছে, মামলার দায়িত্ব পাবার পর পুনরায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পিবিআই৷ তদন্তে পিবিআই জানতে পারে নিহতের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল ইজিবাইক চালক মো. রুবেলের (২৭)৷ কিন্তু ঘটনার দু’দিন পর থেকে তার কোন খোঁজ নেই৷ প্রযুক্তির মাধ্যমে ঘটনার দিন রুবেলের উপস্থিতি ভুক্তভোগীর বাড়ির আশেপাশে পায় পিবিআই৷
সন্দেহভাজন হিসেবে গত শনিবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ি থানা এলারার বোনের বাসা থেকে রুবেলকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ তাকে জিজ্ঞাসাবাদে সে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করে৷ পরে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বাকীরোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেয়৷
জিজ্ঞাসাবাদে আসামি রুবেলের দেওয়া তথ্যের বরাতে পিবিআই জানায়, ব্যাংক থেকে তোলা বাবার ৩০ লাখ টাকা একাই আত্মসাতের লোভে মাসুদ নিজ পিতাকে হত্যার পরিকল্পনা করে৷ নিহতের ছেলে মাসুদ ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে নিজ পিতাকে হত্যার জন্য রুবেলকে ভাড়া করে৷ ঘটনার রাত দশটায় মাসুদের ফোন পেয়ে তাদের বাড়িতে যায় রুবেল৷
রুবেলের জন্য বাসার কলাপসিবল গেট ও ফ্ল্যাটের দরজা আগে থেকেই খোলা রাখে মাসুদ৷ রাত এগারোটার দিকে আব্দুল হালিম ঘুমিয়ে পড়লে মাসুদ তার বার হাত-পা চেপে ধরে এবং রুবেল তার গলি টিপে শ্বাসরোধের চেষ্টা করে৷ ভুক্তভোগী চিৎকার দেবার চেষ্টা করলে রুবেল তার মুখের উপর বালিশ চাপা দেয়৷ হত্যার পর মাসুদ তার কক্ষে থাকা রক্তচাপ মাপর যন্ত্রের সাহায্যে নিজ পিতার মৃত্যু ব্যাপারে নিশ্চিত হন৷
‘পরিকল্পনা অনুযায়ী রুবেলকে ৫ লাখ টাকা দিয়ে সিসিটিভি ক্যামেরার হার্ডড্রাইভ বাইরে কোথাও ফেলে দিতে বলে মাসুদ৷ পরে হত্যার ঘটনা ভিন্নখাতে নিতে ডাকাতির নাটক সাজায়৷ মাসুদকে পাটের দড়ি দিয়ে হাত, পা ও গামছা দিয়ে মুখ বেঁধে রেখে যায় রুবেল৷ চলে যাবার সময় রুবেল হার্ডড্রাইভ ভুক্তভোগীর বাড়ির পেছনে ময়লার স্তুপে ফেলে রেখে যায়৷
পিবিআই পুলিশ সুপার বলেন, ‘রুবেলকে তার বোনের বাসা থেকে গ্রেপ্তারের পর তার দেওয়া তথ্যমতে নারায়ণগঞ্জের ভাডড় বাসার ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে ৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা জব্দ করে৷ এবং ভুক্তভোগীর বাড়ির পেছন থেকে সিসিটিভি ক্যামেরার হার্ডড্রাইভ উদ্ধার করে৷ আলামত হিসেবে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত পাটের দড়ি, গামছা, বালিশ, ডিজিটাল ব্ল্যাড প্রেসার মাপার মেশিন জব্দ করা হয়।
আসামি রুবেল শনিবার বিকেলে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন।