দ্যা বাংলা এক্সপ্রেস ডটকমঃ বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের নেতা শেখ হাসিনা ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে হঠাৎ পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার আগের রাতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তাঁর জেনারেলদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এতে সিদ্ধান্ত হয়, কারফিউ বলবৎ করতে সেনারা বেসামরিক লোকদের ওপর গুলি চালাবেন না। ওই বৈঠকের আলোচনা সম্পর্কে অবগত দুজন সেনা কর্মকর্তা রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান পরদিন সোমবার সকালে শেখ হাসিনাকে জানান, সেনারা দেশজুড়ে জারি করা কারফিউ (বল প্রয়োগ করে) কার্যকর করতে পারবেন না।
ভারতে এ বিষয়ে অবহিত হওয়া একজন সরকারি কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন। ওই ভারতীয় কর্মকর্তা বলেন, বার্তাটি ছিল পরিষ্কার : শেখ হাসিনার প্রতি আর সেনাবাহিনীর সমর্থন নেই।
শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের রবিবার রাতের অনলাইন বৈঠকটির বিশদ বিবরণ এবং শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে দেওয়া সেনাবাহিনীর সমর্থন হারানোর বার্তা আগে প্রকাশিত হয়নি। বৈঠকসংক্রান্ত এসব তথ্য থেকেই বোঝা যায়, কী প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনকাল এমন বিশৃঙ্খল ও আকস্মিকভাবে শেষ হলো।
সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি উদ দৌলা চৌধুরী রবিবার রাতের আলোচনার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছিলেন, এটি যেকোনো বিশৃঙ্খলার ঘটনার পর হালনাগাদ তথ্য নিতে নিয়মিত বৈঠক মাত্র। সেই বৈঠকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে আরো প্রশ্ন করা হলেও তিনি বিস্তারিত কিছু জানাননি।
এ বিষয়ে কথা বলতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। তাঁর ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদের মন্তব্য পাওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
রয়টার্স শেখ হাসিনার শাসনের শেষ ৪৮ ঘণ্টার পরিস্থিতি বোঝার জন্য ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবগত চারজন কর্মরত সেনা কর্মকর্তা এবং অন্য দুটি সূত্রসহ ১০ জনের সঙ্গে কথা বলেছে। বিষয়টি সংবেদনশীল বলে অনেকেই তাঁদের নাম প্রকাশ করতে চাননি।
শেখ হাসিনার প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত সম্পর্কে প্রকাশ্যে কোনো ব্যাখ্যা দেননি সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। কিন্তু তিনজন সাবেক জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, বিক্ষোভের মাত্রা এবং একে কেন্দ্র করে কমপক্ষে ২৪১ জন নিহত হওয়ার কারণে যেকোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকে সমর্থন করা অন্যায্য হতো।
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘সেনাদের মধ্যে অনেক অস্বস্তি ছিল।
সেটিই সম্ভবত সেনাপ্রধানের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। সেনারা বাইরে মোতায়েন ছিলেন। কী ঘটছে, তা তাঁরা দেখছিলেন।’
এর আগে গত শনিবার জেনারেল ওয়াকার সেনাবাহিনীর এক মতবিনিময়সভায় কয়েক শ সেনা কর্মকর্তার উদ্দেশে বক্তব্য দেন। ওই সভার কিছু বিবরণ জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়েছিল। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি উদ দৌলা চৌধুরী বলেন, সেনাপ্রধান সভায় ঘোষণা করেন, প্রাণহানি এড়াতে হবে। সেনা কর্মকর্তাদের ধৈর্য ধরারও আহ্বান জানান তিনি। সেনাবাহিনী যে জোর করে চলমান সহিংস বিক্ষোভ দমন করবে না, এটি ছিল তার প্রথম ইঙ্গিত, যা শেখ হাসিনাকে নাজুক অবস্থায় ফেলে।
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ শাহেদুল আনাম খানসহ কিছু অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা গত সোমবার কারফিউ অমান্য করে রাস্তায় নেমেছিলেন। শাহেদুল আনাম খান বলেন, ‘সেনাবাহিনী তখন আমাদের বাধা দেয়নি। সেনাপ্রধান যেমন অঙ্গীকার করেছিলেন, সেনারা সেভাবেই কাজ করেছেন।’
দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের জন্য ঘোষিত কারফিউয়ের প্রথম দিন ছিল সোমবার। সেদিন শেখ হাসিনা তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনের ভেতরে কার্যত বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিলেন। শহরের রাজপথে জনতার ভিড় ক্রমেই বাড়ছিল। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য আন্দোলনের নেতাদের গণযাত্রার ডাকে সাড়া দিয়ে লাখ লাখ মানুষ বাইরে থেকে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে যেতে থাকে।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়, উল্লিখিত ভারতীয় কর্মকর্তা এবং বিষয়টি সম্পর্কে অবগত দুজন বাংলাদেশির তথ্য অনুযায়ী, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনা দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। স্থানীয় সময় দুপুরে তাঁরা একসঙ্গে বিমানযোগে ভারতের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন।
ভারতের আরেকজন সরকারি কর্মকর্তা বলেন, শেখ হাসিনাকে ‘কূটনৈতিকভাবে’ জানানো হয়েছিল, ঢাকার পরবর্তী সরকারের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পাওে এ আশঙ্কা থাকায় ভারতে তাঁর অবস্থান হতে হবে সাময়িক। এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য রয়টার্সের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলেও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া পাওয়া যায়নি।
রয়টার্স বলেছে, দেশ থেকে শেখ হাসিনাকে চলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ায় কিছু অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ শাহেদুল আনাম খান বার্তা সংস্থাটিকে বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, তাঁকে নিরাপদে চলে যেতে দেওয়া উচিত হয়নি। এটি একটি বোকামি।’