দ্যা বাংলা এক্সপ্রেস ডটকমঃ সারাদেশে ওষুধের দোকান বা ফার্মেসি রয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার ৭৯১টি। এটি নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা। তবে এর মধ্যে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৬৯৩টি ফার্মেসির নিবন্ধন মেয়াদোত্তীর্ণ। নিয়ম অনুযায়ী, ফার্মাসিস্ট ছাড়া ফার্মেসি নিবন্ধন পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে ওষুধের দোকানে গেলে ফার্মাসিস্টের দেখা মেলে না। তদারকি না থাকায় ফার্মাসিস্টহীন ওষুধের দোকান বছরের পর বছর অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে। ফলে রোগীরা সব সময়ই থাকছেন বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।
শুধু তাই নয়, অধিকাংশ ফার্মেসিতেই জীবনরক্ষাকারী ওষুধ সংরক্ষণ ও বিক্রয়ের কোনো নিয়ম মানা হয় না। ফার্মেসিতে যে তাপমাত্রায় ওষুধ রাখার কথা, সেই তাপমাত্রায় রাখা হয় না। এতে ওষুধের গুণগত মানও বজায় থাকে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফার্মাসিস্ট থাকলে এসব ঝুঁকি অনেকটাই কমে যেত। বাংলাদেশে ফার্মাসিস্টদের কাজ জোড়াতালি দিয়ে খুবই অল্প পরিসরে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এতে রোগীরা সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
ফার্মাসিস্ট হলেন ওষুধ বিশেষজ্ঞ। চিকিৎসক রোগীর রোগ নির্ণয় করে প্রেসক্রিপশন বা নির্দেশনা দেন। আর ফার্মাসিস্টের কাজ সেই প্রেসক্রিপশন পুনঃপরীক্ষণ, ওষুধ তৈরি, রোগীকে বিতরণ এবং ওষুধের ব্যবহারবিধি ও সংরক্ষণ নিয়ে রোগীকে পরামর্শ দেওয়া।
দেশের ১৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ২৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মাসি বিভাগ চালু রয়েছে। সেগুলো থেকে পাস করা ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৪৭ জন ফার্মাসিস্ট রয়েছেন দেশে। তাদের অধিকাংশই ওষুধ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। ফার্মেসিতে বসা ফার্মাসিস্ট নেই বললেই চলে।
এমন পরিস্থিতিতে আজ বুধবার প্রতিবছরের মতো বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস পালিত হচ্ছে। ফার্মাসিস্টদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ফার্মাসিউটিক্যাল আন্তর্জাতিক ফেডারেশন (এফআইপি) এবারের দিবসে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘ফার্মাসিস্ট: বৈশ্বিক স্বাস্থ্য চাহিদার প্রয়োজনে’।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী দুই বছর পরপর ফার্মেসির নিবন্ধন নবায়ন করতে হয়। তবে গত বছর মাত্র ৪২ হাজার ৮৯৬টি ফার্মেসির নিবন্ধন নবায়ন করা হয়েছে। বাকি ১ লাখ ৭৩ হাজার ফার্মেসি অবৈধভাবে ব্যবস্থা পরিচালনা করছে। ওষুধ আইন অনুযায়ী নিবন্ধনের মেয়াদোত্তীর্ণ ফার্মেসিতে ওষুধ মজুত, প্রদর্শন ও বিক্রয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
তবে বছরের পর বছর অবৈধভাবে চললেও খুব একটা ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি তদারকির দায়িত্বে থাকা ঔষধ প্রশাসনকে। বছরে একবার হলেও এসব ফার্মেসি পরিদর্শনের দায়ি¡ এই সংস্থার। তবে গত বছর মাত্র ৬৩ হাজার ৯৭১টি ফার্মেসি পরিদর্শন করা হয়েছে, যা মাত্র ২৯ শতাংশ।
গতকাল রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় সরেজমিন মেসার্স চৌধুরী ফার্মেসি, মেসার্স সেবা মেডিকেল ফার্মেসি, মেসার্স হোসেন ফার্মেসি, মেসার্স জনতা ফার্মেসি, রাইপ ফার্মা, মেসার্স বিছমিল্লাহ ফার্মেসি ও দুলাল ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্ট পাওয়া যায়নি। শাহবাগ এলাকায় প্রায় ৫০টি ওষুধের দোকান রয়েছে। অধিকাংশ দোকানের একই অবস্থা। এমনকি হাতিরপুলে ওষুধ বিক্রির বড় প্রতিষ্ঠান লার্জ ফার্মাও ফার্মাসিস্ট ছাড়া চলছে।
যোগাযোগ করা হলে লার্জ ফার্মার স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ লুৎফর রহমান বলেন, লাজ ফার্মার নামে শহরজুড়ে ৬৫টি ফার্মেসি রয়েছে। নিজে কয়েকটি পরিচালনা করি। অন্য ফার্মেসিগুলো ব্যবসা পরিচালনার স্বার্থে লাজ ফার্মার ব্র্যান্ড নাম ও লোগো ব্যবহার করে। আমাদের নীতিমালায় ফার্মাসিস্ট ছাড়া ফার্মেসি ব্যবসা পরিচালনা করার সুযোগ নেই। তবে ফার্মাসিস্ট সংকট থাকায় কয়েক জায়গায় এমন পরিস্থিতি হতে পারে।
বারিধারা জেনারেল হাসপাতালের ফার্মেসি, মিটফোর্ডের নাঈম ফার্মেসি, শাকিল ব্রাদার্স, সাহারা ড্রাগস, রাজীব এন্টারপ্রাইজ, আল আকসা মেডিসিন, আলাউদ্দিন মেডিসিন ফার্মেসি নিবন্ধন ছাড়াই চলছে। পরিচালনায় নেই দক্ষ ফার্মাসিস্ট। এসব প্রতিষ্ঠানে নকল ওষুধ বিক্রির প্রমাণ পাওয়ায় সম্প্রতি সিলগালা করে দেয় ঔষধ প্রশাসন। তবে কয়েক দিন পরই আবার সেগুলো চালু হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, জাপানের কানাজাওয়া ইউনিভার্সিটি ও জার্মানির এবাহার্ড কার্ল ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বাজারে ১০ শতাংশ মানহীন ও ভেজাল ওষুধ রয়েছে। এ ছাড়া একই প্রতিষ্ঠানের তৈরি একই ধরনের ওষুধের ক্ষেত্রে পার্থক্য পাওয়া গেছে।
এটিকে উদ্বেগজনক বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ফার্মেসি সংখ্যা কমিয়ে তদারকি বাড়ানোর পরামর্শ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য ও ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. সাইয়েদুর রহমানের। তিনি সমকালকে বলেন, বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় পাঁচ গুণ ফার্মেসি রয়েছে। দেশে ৪০ হাজার ফার্মেসি হলে ঠিক হতো। গত দুই বছরে ১ লাখের বেশি ফার্মেসির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত ফার্মেসি হওয়ায় ঔষধ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
তিনি বলেন, যারা ফার্মেসি পরিচালনা করছে, তারা শুধু তিন মাসের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। সেই প্রশিক্ষণের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এ কারণে ওষুধের বিতরণ ও বিক্রি ব্যবস্থাপনা দুর্বল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মাসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক আ. ব. ম. ফারুক বলেন, উন্নত দেশে ফার্মাসিস্ট দিয়ে ফার্মেসি পরিচালনা করা হয়। আমাদের দেশে এমন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে মুদি দোকানেও ওষুধ বিক্রি হয়। ফার্মেসিতে বিক্রেতারা ওষুধ সংরক্ষণ করে মুদি দোকানের মালপত্রের মতো। এজন্য ওষুধের কার্যকারিতাও অনেক কমে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একদম থাকে না। এতে অনেক ক্ষেত্রে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ খেয়েও অনেকে ঝুঁকিতে পড়ছে।
গত বছর সেপ্টেম্বরে ওষুধ আইন পাস হয়েছে। তবে অবৈধভাবে চলা একটি ফার্মেসিও স্থায়ীভাবে বন্ধের উদ্যোগ নেয়নি ঔষধ প্রশাসন। গতকাল মঙ্গলবার ঔষধ প্রশাসনের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, নতুন আইনে ঔষধ প্রশাসনকে নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এটি ব্যবহারে একটি নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে। নীতিমালা হলে এসব ফার্মেসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আকতার হোসেন সমকালকে বলেন, শুধু নিবন্ধনের মেয়াদ পার হওয়াই নয়, নিবন্ধনহীন অনেক ফার্মেসি রয়েছে। এগুলো খুঁজে বের করা জরুরি।
তাঁর ভাষ্য, জনবল সংকটের কারণে যথাযথ তদারিক করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে মানহীন-ভেজাল ওষুধ বিক্রি রোধে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সব সময়ই তৎপর।
তবে কেন ওষুধের দোকান বাড়ছে, তা নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন আকতার হোসেন। তিনি বলেন, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে দোকানিরা কোনোভাবে লাভবান হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা উচিত।