দ্যা বাংলা এক্সপ্রেস ডটকমঃ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ভাওয়ালিয়া পাড়ার ৭নং ওয়ার্ডে শীতলক্ষ্যা নদের তীর দখল করে ডকইয়ার্ড কারখানা গড়ে ওঠেছে। নদ দখলের পাশাপাশি পরিবেশ দূষণেরও অভিযোগ রয়েছে বিআইডব্লিউটিএর সনদ নবায়ন ও পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই ব্যবসা করা এসব ডকইয়ার্ডের বিরুদ্ধে। এসব ডকইয়ার্ডে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে স্যান্ড ব্লাস্টিংয়ে সৃষ্ট ধুলায় বায়ুদূষণ হচ্ছে।
এসব ডকইয়ার্ডে দিন-রাত পর্যন্ত এই দূষণ চলছে। এতে এলার্জি, চর্ম, শ্বাসকষ্টজনিত নানা অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে বারবার অভিযোগ করার পরও বিষয়টিতে কর্ণপাত করেছেন না ডকইয়ার্ড মালিকেরা। এবার জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগ দেয়া হয়েছে ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন স্থানীয়রা।
এতদিন এলাকার পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের ম্যানেজ, পরিবেশ অধিদফতর কর্মকর্তা আর সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই শীতলক্ষ্যা ভরাট করে মিজান ডকইয়ার্ড, তুহিন ডকইয়ার্ড ও মালেক ডকইয়ার্ড এসব কারখানা গড়ে উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শীতলক্ষ্যা নদের তারাবো থেকে দাউদপুর পর্যন্ত ২১ কিলোমিটারে নদের সীমানা চিহ্নিত করে ২ হাজার ১২টি পিলার স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১ হাজার ১২৩ টি পিলার নদের সীমানার সঠিক স্থানে বসানো হয়নি বলে আপত্তি জানিয়েছে সংস্থাটি। এসব পিলারগুলোর বেশির ভাগ অতিক্রম করে গড়ে তোলা হয়েছে জাহাজ শিল্পের কারখানা। জানা গেছে, শীতলক্ষ্যা নদের দু’পাড়ে প্রায় ৩০টি জাহাজ শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যে অধিকাংশেরই পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নেই।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শীতলক্ষ্যার কায়েতপাড়া ভাওয়ালিয়া পাড়ায় তুহিন ডকইয়ার্ড, মালেক ডকইয়ার্ড, মিজান ডকইয়ার্ড সহ বেশ কয়েকটি ডকইয়ার্ড গড়ে উঠেছে। এসব কারখানার কোনটিরই অনুমতি নেই।
গত কয়েক দিন ঘুরে দেখা যায়, শীতলক্ষ্যা নদের তীরে এসব ডকইয়ার্ডে নতুন জাহাজ তৈরির পাশাপাশি পুরনো জাহাজ মেরামতের কাজও চলছে। বালি ফেলে নদ ভরাটের চিত্রও দেখা যায়। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা। তাদের কারোরই সুরক্ষা সরঞ্জাম নেই।
বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ দেখা যায় মালেক ডকইয়ার্ডে স্যান্ড ব্লাস্টিং চলছে। ধুলোয় স্যান্ড ব্লাস্টিং করা শ্রমিককে দেখা যায় না। সামনেই প্রবাহিত শীতলক্ষ্যা নদীর বাতাসে এই ধুলো আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করছে। পরে তা নিশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা গেছে, ‘স্যান্ড ব্লাস্টিং’ নামক নির্মাণ প্রক্রিয়ার কারণে ডকইয়ার্ডে ধুলার সৃষ্টি হয়। তবে সঠিক নিয়মকানুন মেনে এ কাজ করলে আশপাশের পরিবেশ দূষিত হয় না। কিন্তু খরচ বাঁচাতে তা না মেনে স্যান্ড ব্লাস্টিং করায় ক্ষুদ্র ধূলিকণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
ডকইয়ার্ডের নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক এক শ্রমিক বলেন, ডকইয়ার্ডে মেরামত বা নির্মাণাধীন জাহাজের গায়ে লেগে থাকা জং তুলতে স্যান্ড ব্লাস্টিং করা হয়। এতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কম্প্রেসর যন্ত্রের মাধ্যমে সিলেটি সিপ্টিন বালু জাহাজের গায়ে নিক্ষেপ করা হয়। এতে জং উঠলেও জাহাজের গায়ে লেগে বালু আরও ভেঙে কুয়াশার মতো বাতাসে ছড়িয়ে যায়।এসব ডকইয়ার্ডের পরিবেশ ও শব্দ দূষণ নিয়ে বিভিন্ন সময় অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি। তারা জানান, মালেক ডকইয়ার্ডের নিজস্ব জমি রয়েছে ৩০/৪০ ফিট। শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ের সরকারি ৪০০/৫০০ ফিট জমি তারা দখলে নিয়ে বালু ভরাট করে ডকইয়ার্ডের কার্যক্রম চালাচ্ছে। সাবেক চেয়ারম্যান জায়েদ আলীর সহযোগীতায় সরকারি হালটও নেয়া হয়েছে মালেক ডকইয়ার্ডের দখলে।
২৪ ঘণ্টাই চালু থাকে ডকইয়ার্ডগুলো। শব্দদূষণে বাড়িঘরে থাকাও কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। স্যান্ড ব্লাস্টিংয়ের কারণে ঘরবাড়ি ধুলোয় ভরে যাচ্ছে। মানুষ ঠিকভাবে দম নিতে পারে না। ঠান্ডা, শ্বাসকষ্ট লেগেই থাকে সারাবছর। অনেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। কেউ এসবের প্রতিবাদ করলে তাঁকে সাবেক চেয়ারম্যান জায়েদ আলীর অফিসে নিয়ে মারধর করে বেঁধে রাখা হতো বলে অভিযোগ জানিয়েছে এলাকাবাসী।
তারা জানান, মালেক তুহিন ইয়ার্ডের পরিচালক উজ্জ্বলের নিজস্ব একটি সন্ত্রাসী বাহিনী রয়েছে। তিনি সাবেক এমপি সালমান এফ রহমানের ঘনিষ্ঠ ও আওয়ামী লীগ নেতা বলে পরিচয় দেন। এলাকার কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে গুলি করে মেরে ফেলে শীতলক্ষ্যায় লাশ ভাসিয়ে দেয়ার হুমকি দেন উজ্জ্বল। তাই ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসে না। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার পতনের পর আবারও এলাকাবাসী সকলে মিলে অবৈধ এসব ডকইয়ার্ডের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে।
নারায়গঞ্জ জেলা প্রশাসক ও রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। তুহিন-মালেক ডকইয়ার্ডের পরিচালক উজ্জ্বল বলেন, এলাকাবাসীর যেহেতু সমস্যা হচ্ছে মেঘনার পাড়ে ও খুলনাতে আমাদের নিজস্ব জায়গা রয়েছে। এলাকাবাসী কিছুদিন সময় দিলে সেখানে আমরা চলে যাবো।
নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক এ.এইচ. এম রাশেদ বলেন, আমি এখনও অভিযোগ পাইনি। আমার কাছে অভিযোগ আসলে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নিবো। অনুমতি না থাকলে পদক্ষেপ নিবো। সত্যতা পেলে যারা নদী দখল করে ডকইয়ার্ড করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাইফুল ইসলামের ফোনে কল দেয়া হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।