দ্যা বাংলা এক্সপ্রেস ডটকম: নিজেদের ইতিহাসে ভয়াবহতম ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে লড়ছে বাংলাদেশ। মশাবাহিত এই রোগে দেশে চলতি বছর এখন পর্যন্ত সাড়ে ছয়শ’র বেশি মানুষ মারা গেছে, আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ বিস্তারের জন্য জলবায়ু সংকট এবং এল নিনো আবহাওয়া পরিস্থিতি দায়ী বলে মনে করছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিøউএইচও) বিশেষজ্ঞরা। এটিকে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপদের হাতছানি বলে মন্তব্য করেন তারা।
ডবিøউএইচও’র তথ্যমতে, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবে ভয়াবহ চাপের মুখে রয়েছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। হাসপাতালগুলোতে উপচে পড়ছে রোগী, দেখা দিয়েছে বেডের তীব্র সংকট। রোগীদের সেবা-শুশ্রুষার জন্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদেরও। কেবল গত ১২ আগস্টই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে প্রায় ১০ হাজার রোগী।
ডবিøউএইচওর মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গ্যাব্রিয়েসুস গত বুধবার (৬ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বাংলাদেশে গত এপ্রিলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে ৬৫০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ৩০০ জনেরই মৃত্যু হয়েছে আগস্ট মাসে।
বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব নতুন নয়। প্রতি বছরই এর ভুক্তভোগী হতে হয় অরক্ষিত জনগণকে। তবে এ বছর প্রত্যাশিত সময়ের অনেক আগেই শুরু হয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ।
গ্যাব্রিয়েসুস জানিয়েছেন, প্রাদুর্ভাবের সময় নজরদারি, ল্যাবের সক্ষমতা, ক্লিনিকাল ম্যানেজমেন্ট, মশা নিয়ন্ত্রণ, যোগাযোগ এবং স¤প্রদায় সংযোগের কাজে বাংলাদেশ সরকার এবং কর্তৃপক্ষগুলোকে সহায়তা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
তিনি বলেন, আমরা চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং মাঠপর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের মোতায়েন করেছি। আমরা ডেঙ্গু পরীক্ষা এবং রোগীদের সেবাযতেœর জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও সরবরাহ করেছি।
ডবিøউএইচও’র মতে, বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে প্রতি বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এতে আক্রান্ত হয় ১০ কোটি থেকে ৪০ কোটি মানুষ।
সংস্থাটি বলছে, এ বছর বাংলাদেশের ৬৪টি জেলাতেই ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। তবে রাজধানী ঢাকায় এর প্রকোপ ছিল সবচেয়ে বেশি।
ডবিøউএইচও মহাসচিব বলেছেন, ঢাকায় সংক্রমণ কমতে শুরু করেছে। তবে দেশের অন্যান্য অংশে বাড়ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে একটি ঢাকা। এ শহরে দ্রæত অপরিকল্পিত নগরায়ন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার গত মাসে ল্যানসেট জার্নালে লিখেছেন, ঢাকায় পানি সরবরাহের সমস্যা রয়েছে। তাই বাসিন্দারা তাদের বাথরুমে বা বাড়ির অন্যান্য জায়গায় বালতি বা প্লাস্টিকের পাত্রে পানি ধরে রাখেন। সেখানে সারা বছরই মশা থাকতে পারে।
তিনি বলেন, আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা সুপরিকল্পিত নয়। রাস্তায় আবর্জনার স্তুপ; ছোট ছোট অনেক প্লাস্টিকের পাত্রে পানি জমে থাকতে দেখবেন। আমাদের অসংখ্য বহুতল ভবন রয়েছে, যার বেজমেন্টে রয়েছে কার পার্কিং। মানুষজন সেখানে গাড়ি ধুয়ে থাকে, যা মশার জন্য আদর্শ।
ডবিøউএইচও জানিয়েছে, প্রকোপ মোকাবিলায় বাংলাদেশ ছয়টি কোভিড-১৯ হাসপাতালকে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিশেষায়িত করেছে। এছাড়া সংক্রমণ শনাক্ত এবং মোকাবিলায় সাহায্যের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে অনুরোধ জানিয়েছে তারা।
দায়ী জলবায়ু সংকট:
ডবিøউএইচও গত আগস্টে বলেছিল, বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে রেকর্ড সংখ্যক আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনার কারণ দেশটি উচ্চ তাপমাত্রা এবং উচ্চ আর্দ্রতার মধ্যে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত দেখেছে, যার ফলে সারা দেশে মশার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উষ্ণ, আর্দ্র পরিস্থিতি রোগবাহী মশার জন্য নিখুঁত প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করে। আবার, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়নোর কারণে পৃথিবী দ্রæত উত্তপ্ত হচ্ছে, যার ফলে নতুন নতুন অঞ্চলে প্রাদুর্ভাব আরও নিয়মিত হয়ে উঠবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বিগত দুই দশকে বিশ্বে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আটগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
উপেক্ষিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান রমন ভেলাউধন জানান, ২০০০ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ লাখ। আর ২০২২ সালে আমরা ৪২ লাখেরও বেশি সংক্রমণ রেকর্ড করেছি।
জলবায়ু সংকট আরও খারাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়ার এবং হলুদ জ্বরের মতো মশাবাহিত রোগগুলো আরও বেশি ছড়িয়ে পড়তে থাকবে এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
ডবিøউএইচওর জরুরি স্বাস্থ্য কর্মসূচির সতর্কতা ও প্রতিক্রিয়া বিষয়ক পরিচালক আবদি মাহামুদ বলেন, আমরা ক্রমাগত আরও বেশি সংখ্যক দেশকে এসব রোগের ভারী বোঝার সম্মুখীন হতে দেখছি।
মাহমুদ বলেন, জলবায়ু সংকট এবং এ বছরের এল নিনো আবহাওয়া পরিস্থিতি সমস্যাটিকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
চলতি বছর দক্ষিণ আমেরিকায় ডেঙ্গুর মারাত্মক প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে লড়ছে পেরু। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ায় বেশ কয়েকটি কাউন্টিকে সতর্কতা জারি করতে হয়েছে। এশিয়ায় বাংলাদেশের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায়় রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এছাড়া সাব-সারাহান আফ্রিকার দেশগুলোতেও ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া গেছে।
এই প্রাদুর্ভাবগুলোকে ‘জলবায়ু সংকটে বড় বিপর্যয়ের হাতছানির’ সঙ্গে তুলনা করে ডবিøউএইচও’র এ বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ক্রমবর্ধমান এই মহামারি মোকাবিলায় প্রয়োজন বিশ্বব্যাপী সংহতি ও সমর্থন।
সূত্র: সিএনএন