দ্যা বাংলা এক্সপ্রেস ডটকমঃ অনেক বছর যাবৎ দেশের সবচেয়ে দূষিত নদী ঢাকার কুল ঘেঁষে আসা নারায়ণগঞ্জ জেলা দিয়ে প্রবাহমান বুড়িগঙ্গা। শুধু দেশের নয়,সারা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০ নদীরও অন্যতম এ বুড়িগঙ্গা। পরিবেশ ইস্যুতে কাজ করা কনজার্ভ এনার্জি ফিউচারের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নদীগুলোর মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর অবস্থান পঞ্চম।
প্রতি বছর ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা নদীর তীড়ে গড়ে উঠছে বৈধ্য ও অবৈধ্য বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান,বাজার, বাসাবাড়ি ও ভ্রাম্যমান আশ্রয়¯’ল।এর ফলে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা এই সব শিল্পপ্রতষ্ঠান,বাসাবাড়ি ও বাজারের বর্জ্য প্রতিনিয়ত নদীতে ফেলা হচ্ছে যার ফলে দূষিত হচ্ছে নদী।এছাড়াও বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকের কেমিকেল মিশ্রিত বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদীতে।
এই দূষণের মাত্রা বিবেচনায় বুড়িগঙ্গা এখন সঙ্কটাপন্ন। রাজধানীর প্রান্ত ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদীটির পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন পৌঁছেছে শূন্যের কোটায়। বুড়িগঙ্গার পানির দূষণমাত্রা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার পানিতে প্রতি লিটারে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ সদরঘাট এলাকায় শূন্য দশমিক ২৪ মিলিগ্রাম, ধোলাইখালের ফরিদাবাদ এলাকায় দশমিক ৭৯, শ্যামপুর খালের মুখে দশমিক ৯৮, পাগলা ওয়াসা ট্রিটমেন্ট প্লান্টের নির্গমন ড্রেনের ভাটিতে দশমিক ৫৬, পাগলায় দশমিক ৬৩, মিটফোর্ড হাসপাতালের কাছে দশমিক ২৯, চাঁদনী ঘাটে দশমিক ৫১, শিকদার মেডিক্যাল এলাকায় এক দশমিক ৫১ ও গাবতলী ব্রিজের নিচে দুই দশমিক দুই মিলিগ্রাম। যদিও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ২০০৭ অনুযায়ী, মৎস্য ও জলজ প্রাণীর জন্য প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকা প্রয়োজন পাঁচ মিলিগ্রাম বা তার বেশি।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে ঢাকার প্রধান চার নদী বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীতে প্রতিদিন প্রায় ১৫,০০০ ঘন মিটার বর্জ্য মিশ্রিত পানি গিয়ে মিশছে আশে পাশের কলকারখানা থেকে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ শিল্পবর্জ্য প্রায় ২০০টি উৎস মুখ দিয়ে নদীতে পড়ছে। নদীর নাব্যতা রক্ষায় ও উৎসমুখগুলো বন্ধে ২০০৯ সালে সরকার টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করলেও এই উৎসগুলো বন্ধ করতে পারেনি।
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের আশেপাশে শিল্পকারখানাগুলোতে তরল বর্জ্যর পানি শোধনাগার ইটিপি প্লান থাকলেও করা হচ্ছে না ব্যবহার শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কর্মপরিকল্পনার একটি প্রতিবেদন বলছে, বুড়িগঙ্গার পানিতে ক্রোমিয়াম, নাইট্রেট, সিসাসহ অপরিশোধিত রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে।
যে হারে বুড়িগঙ্গা নদী দুষিত ও ভরাট হচ্ছে এক সময় বুড়িগঙ্গা নদীর অস্তিত্ব থাকবে কিনা সন্দেহ বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা।তারা আরো বলছে,এক সময় এই নদীটির পানি এতটাই স্বচ্ছ ছিল যে, এ নদীতে মাছের উপস্থিতি স্পষ্ট দেখা যেত। কিন্তু এখন বুড়িগঙ্গা নদীকে যেনো আর চিরচিনা মনে হচ্ছে না। নদীতে বিভিন্ন কল কারখানা ও চামড়া শিল্পনগরীর বর্জ্য ফেলা হচ্ছে,এতে দূষিত হচ্ছে নদী এবং বদলে গেছে পানির রং। স্বচ্ছ পানি থেকে এখন ড্রেনেজ পানির মত কালো রঙ ধারন করেছে।যা মানব দেহ,পশু পাখি স্বা¯ে’্যর জন্য ও শাক সবজির জন্য ক্ষতিকর।আর এই নদীকে বাঁচাতে প্রয়োজন কঠোর আইনের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থার।
একসময় হাজারীবাগের ট্যানারি বর্জ্যও মিশত বুড়িগঙ্গাতেই। আর বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা টেক্সটাইল কারখানাসহ অন্যান্য শিল্প-কারখানার ৯০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য প্রতিদিন নদীটিতে পড়ছে। ১৭৮টি নালামুখ দিয়ে এসব বর্জ্য বুড়িগঙ্গার পানিতে মিশছে
বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ রোধে আদালতের নির্দেশ, একাধিকবার জরিমানা নানা ধরনের শাস্তি দেয়া হয়েছে নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা শিল্প-কলকারখানাগুলোকে। কিন্ত এত কিছু সত্ত্বেও নদীদূষণ বন্ধ করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ বিষয়ে বলেন, নদীগুলোর দখল-দূষণ রোধে কাজ হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে। এখন সরকার নদীগুলো দখলমুক্ত করতে চাইলেও দূষণের ক্ষেত্রে অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই।
কনজার্ভ এনার্জি ফিউচারের ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের দূষিত নদীর তালিকায় সবার উপরে আছে ভারতের গঙ্গা। দ্বিতীয় শীর্ষ নদীটি ইন্দোনেশিয়ার সিতারাম। তৃতীয় শীর্ষ নদী চীনের ইয়েলো। এরপর শীর্ষ দূষিত নদীটি ইউরোপে। ইতালির সারনো নদী রয়েছে সবচেয়ে দূষিত নদীর তালিকায় চতুর্থ স্থানে। আর পঞ্চম শীর্ষ দূষিত নদীটি ঢাকার বুড়িগঙ্গা। যদিও ২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাসের তালিকায় বিশ্বের শীর্ষ দূষিত নদীগুলোর তালিকায় ঢাকার বুড়িগঙ্গা ছিল ষষ্ঠ স্থানে।
নদীতীরবর্তী এলাকায় ¯’াপিত কারখানাগুলোর বেশির ভাগেরই বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা (ইটিপি)নেই। এসব কারখানা নদীতেই সরাসরি বর্জ্য ফেলছে। আর যেসব কারখানায় ইটিপি রয়েছে, তাদেরও অনেকেই তা ব্যবহার করছে না। ফলে পরিশোধন ছাড়াই বর্জ্য নদীতে ফেলছে এসব কারখানা। বাংলাদেশ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) মাধ্যমে করা পরিবেশ অধিদফতরের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর চারপাশের নদ-নদীগুলোয় প্রতিদিন সাড়ে চার হাজার টন বর্জ্য ও ৫৭ লাখ গ্যালন দূষিত পানি মিশছে।
মৎস্য অধিদফতর ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের প্রতিবেদনের তথ্য মতে, পানিদূষণের কারণে রাজধানীর নদ-নদীগুলোর বেশির ভাগ স্থানই মাছের বেঁচে থাকার জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। নদ-নদীগুলোতে ক্রোমিয়াম, আয়রন ও জিংকের মতো ভারী ধাতু মানমাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, মানমাত্রা লিটারপ্রতি শূন্য দশমিক পাঁচ মাইক্রোগ্রাম হলেও নদ-নদীগুলোতে পাওয়া গেছে শূন্য দশমিক আট থেকে আট দশমিক দুই মাইক্রোগ্রাম।
দূষণের পাশাপাশি দখলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমডোর এম মাহবুব-উল ইসলাম বলেন, এ জন্য বিভিন্ন সং¯’ার সাথে আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করছি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ইটভাটা বা নৌযান কিংবা অন্য যারাই নদী দূষণ করছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে উচ্ছেদও করা হয়েছে। নদীতীরে যেসব অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে, সেগুলোও আমরা অভিযান চালিয়ে ভেঙে ফেলছি। ভবিষ্যতে এ কার্যক্রম আমরা আরো জোরদার করব। প্রয়োজনে নদী দূষণকারীদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হবে।
বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানো প্রয়োজন। এজন্য আইন রয়েছে। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট নদী নিধনকে “যুথবন্ধ আত্মহত্যা” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পরিবেশগত ছাড়পত্রবিহীন যে সব কারখানা ও স্থাপনা বুড়িগঙ্গার পাড়ে রয়েছে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়ার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছিলো হাইকোর্ট। এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি এ ব্যাপারে হাইকোর্টে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেয়। একই দিনে বুড়িগঙ্গার সাথে যুক্ত ড্রেন ও সুয়ারেজ লাইনগুলো পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছিলো ঢাকা ওয়াসাকে।এর আগে বাংলাদেশের নদ-নদী, হাওর, জলাধার ইত্যাদি রক্ষায় পুরনো একটি আইন সংশোধন করে আরও কঠোর করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। যা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩ সংশোধিত আইন নামে পরিচিত।